কয়দিন আগেই বন্ধুদের সাথে বসে আড্ডা দেয়ার মাঝে একটা টপিক চলে আসছিলো যে, আমাদের মিডিয়া বা শিক্ষা ব্যবস্থা সবকিছুর মান কতোটা ব্যাকডেটেড এবং এসব কিভাবে নারী নির্যাতনকে সমাজে স্থাপন করে। সমস্যাগুলো এতোই বড় যে কেউ আর আলাদা করে এদের সমস্যা বলেনা, এটাই নরমাল। আমাদের ঘরে বসে আলোচনা করা বা ব্লগে রচনা লিখায় কিছুই যায় আসেনা, তাও কয়েকটা কথা বলি আজকে।
প্রথমেই বলবো, রেপ এর চেয়েও ভয়াবহ সমস্যা হচ্ছে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স। আমি গ্যারান্টি রেখে বলতে পারি, এই পোস্ট যারা পড়ছেন তাদের প্রত্যেকের পরিচিত এক বা একাধিক নারী আছেন যারা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স এর শিকার। রেপগুলো আমাদের চোখে পড়ে, ভাইরাল হয়। কিন্তু লাখ লাখ নারী যে প্রতিটাদিন নিজের ঘরে লাঞ্ছনা পোহায়, সেটা আমাদের চোখে পড়েনা। কোন কোন ক্ষেত্রে ছেলের পরিবারের মানুষরাও যুক্ত হয় এই নির্যাতনে। কেন এটা এতো স্বাভাবিক ঘটনা আমাদের উপমহাদেশে? মেয়েদের প্রতি এতোটা অসম্মান কেন? আমাদের সমাজ বইতে পড়ানো হতো যে গ্রামের মানুষের বিনোদনের অভাব তাই সেখানে পরিবার প্রতি সন্তান বেশি নেয়া হয়। সমস্যার শুরুটা বোধহয় ওখান থেকেই। সমাজে মেয়েরা নেহাতই ভোগ্যপন্য। সমস্যাটা ওখানে, যখন বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে এসে মেয়েকে হাটের গরুর মতো দেখা হয়। সমস্যাটা ওখানেই যখন ছেলেটা প্রথমবার বউএর গায়ে হাত তোলে আর মেয়েটা সেটা চেপে যায়। এভাবে চেপে যেতে যেতে কবে যে আত্মাটা মরে যায় সেটাও হয়তো মেয়েটা টের পায়না। তার কিই বা করার আছে। নিজের বাবা মা যখন বিয়ের পরে মেয়েকে আর ঘরে ফেরত আসতে দেখতে চায়না, সমাজ কি বলবে সেই ভয়ে, সেই মেয়ে যাবেই বা কোথায়? সবাই বলবে আর কয়েকটা দিন দেখ, ঠিক হয়ে যাবে, বাচ্চা নিয়ে নে, ঠিক হয়ে যাবে। আরে ভাই, যেই পুরুষ একবার কোন মেয়ের গায়ে হাত তুলছে আর পার পেয়ে গেছে, সে জীবনেও ঠিক হবেনা। আমরা সমাজ বইতে পড়তাম, অনেক অনেক বছর আগে বিদ্যাসাগর কি বলে গিয়েছেন, বিধবা বিবাহ প্রচলনের জন্য কিকি করেছেন। কখনো কি এগুলার তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা হয় আমাদের ক্লাসরুমে? কয়েকটা সাল মুখস্থ করো আর খাতায় বমি করো। এজন্য একটা মেয়ে অনেক অত্যাচারের মুখেও হয়তো বাবা মা পরিবার সমাজ সবকিছুর চাপে ওই ছেলের কাছে পরে থাকতে বাধ্য হয়। সংসার টিকাতে না পারলে তো তারই বদনাম। কে আবার বিয়ে করবে এমন মেয়েকে!!! সমাজের পুরুষগুলাও এমন নপুংসক হয়ে গিয়েছে, তারাও জগতের সমস্ত ক্ষোভ, রাগ মেয়েদের উপর ঝেরেই নিজেকে খুব বাপের বেটা মনে করে। বউকে সাইজ করে রাখতে পারাটা একটা বিশাল ক্রেডিটের কাজ আমাদের সমাজে। এমনও দেখেছি, মেয়েকে অত্যাচার করে মেয়ের বাপের বাড়িকে শায়েস্তা করে, এমনও দেখেছি নিজের বউয়ের সাথে জোরপূর্বক সেক্স করে, পরিবার থেকেও মেয়েকে চাপ দেয়, ছেলে যাযা চায় দিতে। অনেক প্রতিষ্ঠিত, উচ্চ শিক্ষিত মেয়েরাও ঘরের বাইরে কয়েকশ জন মানুষকে চালায় ঘরে এসে এসবের শিকার হয়, বাইরে সবাই তাকে ম্যাডাম ম্যাডাম ডেকে সম্মান দিলেও নিজের ঘরে তার সম্মান নাই। ঘেন্না হয়, প্রচন্ড ঘেন্না হয়। এই শিক্ষিত ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ভরা হিপোক্রেট সমাজটাকে প্রচন্ড ঘেন্না করি।
সেদিনই দিল্লির রাস্তায় করা একটা ভিডিও তে সমাজের গন্যমান্য কিছু পুরুষদের সাক্ষাৎকার নিতে দেখলাম। তাদের জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনি মেয়েদের সম্মান করেন? সাথে সাথে উত্তর, অবশ্যই! মেয়েরা মা হয়, ভগবানের আশীর্বাদ, ব্লা ব্লা। আরেকটা প্রশ্ন ছিল, এতো রেপ কেন হয় সেটা নিয়ে। সেখানে তাদের উত্তর ছিল, মেয়েরা আজেবাজে কাপড় পড়ে, ছেলেদের উত্তেজনা উঠে যায়, উত্তেজনা উঠলে কিছু করে ফেলতেই পারে। তাদের মতে মেয়েরাও চায় তাদের সাথে ছেলেরা এসব করুক। উল্লেখ্য যে, দিল্লীকে বলা হয় পৃথিবীর রেপ ক্যাপিটাল। যে পুরুষগুলা ঘরে বউদের উপর জুলুম করে লাইফে মিনিং খুজে পায় তারা এসব বলবেই। অফিস আদালত ব্যবসা রাস্তা ঘাট জীবন, সবকিছু নিয়ে তারা হতাশ। বউ পিটালে সম্ভবত সেন্স অফ ফুলফিলমেন্ট পায় তারা। এই সেন্স অফ ফুলফিলমেন্ট প্রতিটা মানুষের জীবনেই দরকার। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের জাতির অকর্মণ্য পুরুষরা সেটা নির্যাতনে খুঁজে নেয়।
একটু শিক্ষা নিয়ে কথা বলা যাক। প্রতি বছর যে হারে গোল্ডেন এ প্লাস বাড়ে আর গ্রাজুয়েট বের হয়, সেই হারে শিক্ষিত মানুষ বের হয়না। আমাদের উপমহাদেশের মানুষ মানসিকভাবে ভীষণ অসুস্থ, আর এদের শিক্ষা ছাড়া অন্য কোন কিছু দিয়েই ঠিক করা যাবেনা। অনেকেই বলছে দেখলাম যে ২০০২ সালে এসিড বিরোধি আইন হওয়ার পর এসিড নিক্ষেপের কেইস আর নেই বললেই চলে। কিন্তু মানসিকভাবে কতোটা অসুস্থ হলে কোন মানুষ অন্য আরেকটা মানুষের গায়ে এসিড ছুড়তে পারে, এই ব্যাপারটা নিয়ে কি সুশীল সমাজের মানুষরা কখনো ভেবেছিলেন? আজকে বিচ্ছিন্নভাবে ২/৪জন রেপিস্টকে গনধোলাই দিয়ে বা জেল খাটিয়ে বা ফাঁসি দিলে কি সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে? একটা পুরো জাতির যেখানে মানসিক সমস্যা, সেটার সমাধান শিক্ষা ছাড়া সম্ভব না।
সেক্স নিয়ে কথা বলা খুব খারাপ। নষ্ট ছেলেপেলেরা এসব নিয়ে কথা বলে। নাউজুবিল্লাহ টাইপ কথা। আরো কতো বিশেষণ। কথা না বলা কতটা ভয়ানক সেটা বলি। গুগল ট্রেন্ড নামের একটা জিনিস আছে। সেখানে দেখা যায় যে পৃথিবীর কোন জাগায় মানুষজন কি নিয়ে বেশি সার্চ করে বা ব্রাউজ করে। আমি আগ্রহের বশে মাঝেমধ্যেই বাংলাদেশের ট্রেন্ডগুলো ফলো করি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশের মানুষের বেশিরভাগ সার্চ থাকে পর্ণ, চটি, আরো কিছু কিওয়ার্ড যেগুলো সবারই জানা, লেটেস্ট কোন পপুলার পর্ণস্টার, বা কোন সেলেব্রিটির লিক হওয়া ভিডিও ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বুঝিনা, এতো চুল্কানি কেন??? পরে মনে পড়ে, এরা তো সেক্স সম্পর্কে জানতেই পারে এসব দেখে। হিন্দি মুভি সিরিয়ালে সারাদিন রোমান্স করতে দেখে, অবাধ পর্ণ দেখে, তাদের মনে সেক্স নিয়ে চিন্তাটাই পুরা অন্য লেভেলে থাকে। কিন্তু পর্ণ তো সারাদুনিযার মানুষই দেখে। তাহলে সমস্যাটা কই। ঐযে, সমস্যা ঘর থেকেই শুরু হয়। যে ছেলে নিজের ঘরে নিজের মাকে কখনো সম্মান পেতে দেখেনি, সে অন্য কোন মেয়েকে নিজে সম্মান দিতে পারবেনা। আর তার সাথে যদি বিকৃত ভাবে পাওয়া সেকচুয়াল ফ্যান্টাসিগুলা যোগ করি, সেই ছেলে জীবনের কোন না কোন সময় সুযোগ পাওয়া মাত্র কোন মেয়েকে এবিউজ করবে। সেক্স এডুকেশন আমাদের দেশে এখন একটা নেসেসিটি। ছেলে মেয়ে উভয়ের টিনেজ বয়সেই এই বিষয়ে জ্ঞান থাকাটা নেসেসিটি। অবশ্য কি আর বলবো। কতগুলা সোসিওপ্যাথ তো শিশুদেরও রেহাই দিচ্ছেনা। ঐ শিশুকে আর ভালো ছোয়া, মন্দ ছোয়া কি শেখানো যাবে! তারপরও, যতটা সম্ভব, আমাদের এই বিষয়ে কথা বলতে হবে। একটা মেয়ে যদি কোনভাবে হেনস্থা হয় রাস্তায়, বাসে বা দোকানে, সে কি পারে তার পরিবারকে এসে জানাতে? পিরিয়ডের মতো খুবই সাধারণ একটা বিষয়েই কি মেয়েরা পারে তার বাবার সাথে আলোচনা করতে? কোন মা পারে তার ছেলের সাথে মেয়েদের নিয়ে কথা বলতে? বাইরের দেশগুলাতে সব স্কুল কলেজে আলাদা কাউন্সিলর থাকে। আমাদের দেশে ছেলে মেয়েরা কার সাথে কথা বলবে তাদের ফিলিংস নিয়ে, তাদের ফ্রাস্টেশন নিয়ে? বলতে চাইলে আরো অনেক অনেক কিছু বলা যায়, শিক্ষা বা এই কথা বলার সুযোগটা না থাকলে সবাই যা এভেইলেবল দেখবে সেখান থেকেই শিখবে। বাংলাদেশে ৩৬৫ ডেইজ, বা ৫০ শেডস অফ গ্রে টাইপ মুভি খুবই পপুলার, একদম লিস্টের একনাম্বারে থাকে। এগুলা দেখে বেজন্মা কিছু মানুষের মনে হতেই পারে, আরে, মেয়েরাও তো লাইক করে এসব, কিন্তু ওইসব মুভির ডিসক্লেইমার পড়ে বোঝার মতো জ্ঞান তো নাই। চোখে যা দেখে তাই তার জ্ঞান। আমাদের মিডিয়ার কি দায়িত্ব না দেশে কিছু সুস্থ ধারার বিনোদন নিয়ে আসা? খালি লুতুপুতু প্রেম আর গতানুগতিক কিছু কাহিনী নতুন মোড়কে করে চলে আস্তেছে দিনের পর দিন। থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার এর কথা মনে আছে? একটা একলা মেয়ের কতো সম্মান(!!!) আমাদের সমাজে সেটা খুব সুন্দর করে তুলে ধরেছিল সেখানে। এরকম কাজ আরো অনেক বেশি করা দরকার।
আমি আঈন নিয়ে, সাজা নিয়ে, তেমন কিছুই বললাম না। কি হয় দেখা যাক। কিন্তু এই কনভারসেশনটা ঐ কয়েকজনকে শাস্তি দিয়ে শেষ হয়ে গেলে হবেনা। যতোদিন না মেয়েদের প্রাপ্য সম্মান ছেলেরা নিজে থেকেই দিবে, গায়ের জোরে দেয়াতে হবেনা, তার আগ পর্যন্ত এই কনভারসেশন চালাতে হবে। আর শুরুটা হতে হবে যার যার ঘর থেকেই।
Discover more from J. Istiak
Subscribe to get the latest posts sent to your email.